বিচার বিভাগ কাকে বলে?
সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে একটি হলো বিচার বিভাগ। একটি দেশের বিচার বিভাগ বলতে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, বিরোধ মীমাংসার মাধ্যমে আইনের প্রয়োগ ও শাস্তিপ্রদানকারী বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালসহ সকল ধরনের আদালতকে বোঝায়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে সাধারণত এমন অবস্থা বা পরিবেশকে বোঝায় যেখানে বিচারকগণ আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত হয়ে কারো কাছে নতী স্বীকার না করে বা কোন কিছু দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে কেবলমাত্র আইন ও নিজের বিবেক অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারে।
আমরা জানি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলা করা হয়, “মাসদার হোসেন বনাম সচিব,অর্থ মন্ত্রণালয় ” (১৯৯৫) মামলাটি দীর্ঘদিন চলমান থাকার পর ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ১ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির একটি সংশোধনী অধ্যাদেশ জারি করে বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগ কে আলাদা করা হয়।
বিচার বিভাগ কতদূর স্বাধীন?
বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কতখানি স্বাধীন তা বিচার করতে হলে আমাদেরকে দেখতে হবে বাংলাদেশ সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার শর্ত সমূহ কি কি অবস্থায় রাখা হয়েছে।
১. বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতিঃ
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ -৯৫ এর উপ-অনুচ্ছেদ -১ এ বলা হয়েছে যে,প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কতৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অনন্য বিচারপতিদের নিয়োগ দিবেন।
বিচারকদের নিয়োগপদ্ধতি এমন হতে হবে যে, সৎ যোগ্য এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আইনজীবীগণ বিচারক হওয়ার সুযোগ পায়।কিন্তু নিয়োগপদ্ধতি যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয় যার কারণে ভালো ভালো ব্যাক্তিগণ বিচারক হওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ এর অনুযায়ী বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া হয়েছে, যিনি একজন নির্বাহী বিভাগের প্রধান। যেখানে বিচারকদের নিয়োগক্ষমতা বিচার কমিশনের হাতে রাখা একদম উচিৎ ছিলো বলে আমরা মনে করি।
আবার ১১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অধঃ স্তন আদালত সমুহের বিচারকদের এবং ম্যাজিষ্ট্রেটদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন। মুল সংবিধানে নিয়োগের বিষয়ে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিধান ছিল। তখন বিধান ছিল যে,রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিদের নিয়োগ দিবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ ক্রমে অনন্য বিচারপতিদের নিয়োগ দিবেন। সংবিধান (দ্বাদশ সংবিধানের মাধ্যমে) রাষ্ট্রপতি নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান। সকল নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী এখন প্রধানমন্ত্রী এবং বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে (প্রধান বিচারপতি ব্যতীত) রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালন করতে হয়। ফলে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই চলে আসে।
“১৯৭৭ সালে বিচারপতি এইচ আর খান্নাকে অতিক্রম করে এস এইচ বেগকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়েছিল। এর পিছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো তাহলো ১৯৭৬ সালে বিখ্যাত হেবিয়াস কর্পাস মামলায় বিচারপতি খান্না সরকার বিরোধী রায় দিয়েছিলেন”। – এখানে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ এর কারনে বিচারকদের নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করা হয়েছে।
২. বিচারকদের চাকুরির নিশ্চয়তাঃ
বিচারকদের হয় আজীবনের জন্য, না হয় একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নিয়োগ করতে হবে।
উক্ত বয়সের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা কালে তাদের চাকুরির শর্ত এমন হবে যে,তারা যেন নির্ভীকভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারেন। কিন্তু আমরা অনুচ্ছেদ -৯৬ অনুযায়ী দেখতে পাই, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগে অর্থাৎ জাতীয় সংসদের কাছে দেওয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগ হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য জাতীয় সংসদে সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি বিচারক অপসরাণ ও বদলী করার সুযোগ থেকেই যায়। অর্থাৎ তাদেরকে অপসারণ ও বদলীর ক্ষমতা কোন এককভাবে ব্যাক্তি বা নির্বাহী বিভাগের হাতে না থেকে, তাদেরকে বদলির বা অপসারনের ক্ষেত্রে বিচারকদের কমিশনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে বিচারকগণ তাদের জায়গা থেকে স্বাধীন থাকবেন।
৩.পর্যাপ্ত বেতন ও সুবিধাদিঃ
সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের মেয়াদকালের তাদের পারিশ্রমিক, বিশেষ অধিকার, অনন্য শর্তের এমন তারতম্য করা যাবে না যা তার পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে পড়ে। অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের বেতন ও সুবিধাদি ১১৬ অনুচ্ছেদ এর মাঝেই নিহিত। অর্থাৎ এটা নির্ভর করে আইন মন্ত্রালয়ের উপরে। যদিও সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শ এর বিধান রাখা হয়েছে তথাপিও ইহার নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই শোনা যায়,বিচারকদের বদলির আদেশ,ছুটির প্রাথনা মঞ্জুর সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ না নিয়েই আইন মন্ত্রনালয় এইসব কাজ করে থাকে। কেননা একজন বিচারকদের আচরণ, দক্ষতা এবং মানসিকতা একজন বিচারকই ভালো জানেন। তাই এখানে নির্বাহী বিভাগে হস্তক্ষেপ সমীচীন নয়।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে বলা যায়,নিযোগ পদ্ধতি ও বিচারকদের অপসারণ, বদলি,এবং অধিকার ও পারিশ্রমিক ইত্যাদি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার শর্তকে পূরন করে নি। কারন বিচারকদের এসব কাজগুলো সম্পুর্ণরুপে নির্বাহী বিভাগের উপর ন্যাস্ত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ দীর্ঘসূত্রীতার দোষে দুষ্ট। বাংলাদেশ পূর্ণ ক্ষমতাস্বন্ত্রীকরণ নীতি গৃহীত না হলেও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত রাখার কথা সংবিধানে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ -২২)। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলদা করা হয় নি।
নির্বাহী বিভাগের বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ সম্পর্কে, ১৯১২ সালে ফ্রান্সের আইন মন্ত্রী M. Briand বলেছিলেন, “বিচারকরা রাজনীতিকদের শিকার পরিণত হচ্ছে “
সুতরাং বলা যায়,, আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও কোন সরকারই এই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে সঠিক কোন কথা বলে নি, সবাই নিজের স্বার্থ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক এ জাতির জন্য। এর ফলে হাজারো বিচারপ্রার্থীরা তাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এবং বিচারকরা রাজনৈতিক প্রভাবের কারনে তাদের নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে, যা কখনোই একটি স্বাধীন দেশের জন্য কাম্য নয়। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করবো, বিচার বিভাগের শুধু সংবিধানে স্বাধীনতার কথা থাকলে হবে না, বরং এটাকে বাস্তবে পরিণত করে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে সম্পুর্ন আলাদা করে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে একটি আর্দশ, সুন্দর এবং স্বাধীন সংবিধান উপহার দিয়ে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে আমরা আশা করি।
মো. এম.এইচ. বকুল
আইন বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments are closed.