কোন মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সাধারণত বিধিবদ্ধ আইন অনুসরণ করা হয়। সুতরাং মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিধিবদ্ধ আইনে (Statutory law) যে রকম বিধান আছে সেই সকল বিধান অনুসরণ করে আদালত উক্ত মামলা নিষ্পত্তি করবেন ও রায় দিবেন৷ কিন্তু অনেক সময় আদালত বিধিবদ্ধ আইন অনুসরণ করতে গিয়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয় কারণ সকল মামলার ফ্যাক্ট একই রকম হবে এমন না৷ সে ক্ষেত্রে আদালত ইতিপূর্বে অনুরূপ সমস্যা নিষ্পত্তি হওয়া বিভিন্ন মামলা স্টাডি করেন।
নিন্ম আদালতে কোন মামলা গেলে সেটা সরাসরি বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হয় কিন্তু যদি সে মামলা বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা সমাধান করা কষ্ট সাধ্য হয় তাহলে নিন্ম আদালত উচ্চ আদালতে অনুরূপ মামলায় কি রায় হয়েছিল সেটা দেখে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারেন। এখানে উচ্চ আদালতের নিষ্পত্তি হওয়া সে মামলায় নজীর হিসেবে কাজ করবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ নম্বর আর্টিকেলে বলা আছে,
” The law declared by the Appellate Division shall be binding on the High Court Division and the law declared by either of the Supreme Court shall be binding on all courts subordinate to it.”
“আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হইবে।”
অর্থাৎ, উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত নিবে নিন্ম আদালত সে সকল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মামলা নিষ্পত্তি করবে। এবং উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত সমূহকে বলা হবে নজীর (Precedent)।
নজীরের প্রকারভেদ (Kinds/Classifications of Precedent) :-
আইনী নজীর বিভিন্ন প্রকার হতে পারে সেগুলো হলোঃ
ক. কর্তৃত্বমূলক এবং প্রবর্তক নজীর (Authoritative & Persuasive precedent)
খ. দৃঢ় এবং শর্তসাপেক্ষ নজীর (Absolute & Conditional Precedent)
গ. ঘোষণামূলক ও মৌলিক নজীর ( Declaratory & Orginal Precedent)
কর্তৃত্বমূলক এবং প্রবর্তক নজীর (Authoritative & Persuasive precedent):
যে নজীর বিচারকগণ অনুসরণ করতে বাধ্য অর্থাৎ নিন্ম আদলতের বিচারকরা যদি সেটাকে ভুল ও মনে করে তারপরও তাদের উপর যে নজীর অনুসরণে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে সেটাই হল কর্তৃত্বমূলক নজীর। যদি বলা হয় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ একটা নজীর সৃষ্টি করেছে তাহলে হাইকোর্টকে অবশ্যই সেই নজীর অনুসরণ করে রায় দিতে হবে।
আবার প্রবর্তক নজীর হল বিভিন্ন বিদেশি আদালত দ্বারা সৃষ্টি নজীর যেগুলো বাংলাদেশের আদালত মানতে বাধ্য নয়। যেমনঃ প্রিভী কাউন্সিল(Privy Council), আমেরিকান আদলতের বিভিন্ন রায়। তবে এগুলো বাংলাদেশের বিচারকগণ ও বিবেচনায় নিতে পারবে৷
অর্থাৎ, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের রায় বাংলাদেশের নিন্ম আদালত সমূহের জন্য কর্তৃত্বমূলক নজীর সৃষ্টি করে।
আবার অন্য দেশের আদালত সমূহের রায় বাংলাদেশের আদলত সমূহের জন্য প্রবর্তক নজীর সৃষ্টি করে।
দৃঢ় এবং শর্তসাপেক্ষ নজীর (Absolute & Conditional Precedent):
দৃঢ় ও শর্তসাপেক্ষ নজীর হলো কর্তৃমূলক নজীরের ই প্রকারভেদ। দৃঢ় কর্তৃত্বমূলক নজীরের ক্ষেতে উচ্চ আদলতের রায় আদালত মানতে বাধ্য যদি নিন্ম আদলতের বিচারকগণ সে ব্যাপারে একমত পোষণ নাও করে। কিন্তু শর্ত সাপেক্ষ কর্তৃত্বমূলক নজীরের ক্ষেত্রে আদালত মানতে বাধ্য নয়।
বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ একটি মামলার রায় মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নজীর সৃষ্টি করেছে কিন্তু একই রকম অন্য একটি মামলায় হাইকোর্টের মনে হতে পারে যাবৎজীবন কারাদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ আপিল বিভাগের সৃষ্ট নজীর মানতে বাধ্য কারণ পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় বলা আছে হত্যার শাস্তি মৃত্যু অথনা যাবৎজীবন। সেক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সৃষ্ট নজীর অনুসরণ করতে হবে।
আবার এখানে উচ্চ আদালত যদি ৭ বছর কারাদণ্ড দিত যা বিধিবদ্ধ আইন অনুযায়ী সঠিক নয় সেক্ষেত্রে নিন্ম আদালত তা মানতে বাধ্য নয়।
ঘোষণামূলক ও মৌলিক নজীর ( Declaratory & Orginal Precedent):
ঘোষনামূলক নজীর হল বিধিবদ্ধ আইনে যা আছে সেটাকেই বাস্তব করা।যে নিয়মে ঘোষণা মূলক নজীর সৃষ্টি করা হয় সেই নিয়মই আইন যা মৌলিক নজীর।
আধুনিক রাষ্ট্রে ঘোষণামূলক নজীরের প্রচলন খুব বেশি।অর্থাৎ বিধিবদ্ধ আইনকে বাস্তবে প্রয়োগ করা।
যে সল কারণে নজীর তার কার্যকারিতা হারায় (Circumstances which break the binding force of precedent):
ক. বাতিলকৃত সিদ্ধান্ত (Abrogated Decision):
আদালত কর্তৃক কোন সিদ্ধান্ত জারির পরে যদি পার্লামেন্ট কর্তৃক নতুন কোন আইন পাশ হয় যা ওই সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক তাহলে ওই আইনী সিদ্ধান্ত বা নজীর তার কার্যকারিতা হারায়। অথবা উর্ধ্বস্তরের কোন আদালত যদি ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দেয় তাহলেও উক্ত নজীর (Precedent) তার কার্যকারিতা হারাবে। যেমন ভারতের সংবিধানের চব্বিশতম সংশোধনী আনা হয়েছিল Golak Nath মামলায় দেয়া সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য।
খ.ভিন্ন ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়া (Affirmation on a different Grounds):
কোন মামলায় হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিলো ”A’ দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা আবার আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দিল ”B’ দৃষ্টিকোণ থেকে। হাইকোর্ট বিভাগের রায় বা নজীর তার কার্যকারিতা হারাবে।
গ.বিধিবদ্ধ আইনের লঙ্গন (Ignorance of Statute):
কোন নজীর ই কার্যকর হবে যদি তা বর্তমানে প্রচলিত আইনকে উপেক্ষা করে সৃষ্টি করা হয়। অর্থাৎ বর্তমানে প্রচলিত আইন উপেক্ষা করে নজীর সৃষ্টি করা যাবে না। নজীর অবশ্যই আইনের সাথে মিল রেখেই সৃষ্টি হতে পারবে।
ঘ. উচ্চ আদলতের পূর্বের সিদ্ধান্তের সাথে অমিল (Inconsistency with Higher court):
উচ্চ আদালত যদি কোন রায় পূর্বে প্রদান করে থাকে তাহলে নিন্ম আদালতের সেটা অনুসরণ করতে হবে এটাই সাধারণত নিয়ম কিন্তু যদি নিন্ম আদালত উচ্চ আদালতের পূর্বের রায় আমলে না নিয়ে কোন নজীর সৃষ্টি করতে চায় তাহলে তা কার্যকর হবে না।
ঙ.একই আদালতের পূর্বের রায়ের সাথে অমিল (Inconsistency with same courts):
কোন আদালত রায় দেওয়ার সময় একই আদলতের পূর্বের সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক হয়। অর্থাৎ যদি একই ক্ষমাতার একই আদালতের সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয় এক্ষেত্রে আদালত যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
চ. সমদ্বিখণ্ডির আদালতের আদেশ (Decision Equally Divided Courts) :
কোন সিদ্ধান্তে আদালতের বিচারকগণ যদি সমানভাগে ভাগ হয়ে পক্ষ-বিপক্ষ নেয় তাহলে আপীক রদ করে দিতে হয়৷ তবে বর্তমানে এ সমস্যার অস্তিত্ব নেই কারণ আপিল আদালত সমূহে বেজোড় সংখ্যাক বিচারক নিয়োগ করা হয়।
লেখকঃ শরিফুল ইসলাম
আইন বিভাগ (৪৪তম ব্যাচ)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Comments are closed.