কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরালা (Keshavanda Bharti vs. State of Kerala)

Keshavanda Bharti vs. State of Kerala
Share the content

ভূমিকাঃ ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাসে অন্যতম ল্যান্ডমার্ক মামলা হলো কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরালা। এই মামলায় ভারতীয় সংবিধানের সাথে সম্পর্কিত অনেক প্রশ্ন সমাধান হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন বা সংবিধানের সাথে সম্পর্কিত অনেক বিষয়ের সমাধান হয়েছে এই মামলায়। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মামলাটি সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান থাকা উচিত। নিচে মামলাটি সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ ভারতীয় পার্লামেন্ট ১৯৫১ সালে ভারতীয় সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। এই সংশোধনের মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুসারে ভূমি সংক্রান্ত কিছু পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু এই সংশোধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বসে শংকরা প্রসাদ। Shankari Prasad v. Union of India(1951), এই মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে ভারতীয় পার্লামেন্ট আর্টিকেল ৩৬৮ অনুযায়ী সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার(Basic Structure) সংশোধন করতে পারবে। অর্থাৎ সংবিধানের যেকোনো সংশোধন করার ক্ষমতা রাখে পার্লামেন্ট। পরবর্তীতে আসে পাঞ্জবের গোলকনাথ মামলা Goluknath Case ( 1967), এই মামলায় ভারতীয় সংবিধানের ১৭ তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। মামলাটি মূলত ভূমি সংস্কার আইন(Land Reforms Act) এর সাথে জড়িত। এই আইন অনুযায়ী সরকার যেকোনো সম্পত্তিতে অধিকার স্থাপন করতে পারবে। তখন ৩১ নং অনুচ্ছেদ সক্রিয় ছিল যদিও বর্তমানে এটি নিষ্ক্রিয়। এই অনুচ্ছেদে সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়। গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় পার্লামেন্ট সংবিধানের Basic Structure সংশোধন করতে পারবেনা।

সুপ্রিম কোর্ট আর পার্লামেন্ট শীতল যুদ্ধঃ গোলকনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিলে শুরু হয় বিচার বিভাগ আর পার্লামেন্টের মধ্যে নিরব যুদ্ধ। গোলকনাথ মামলার পরে পার্লামেন্ট সংবিধানের ২৪ তম সংশোধনী নিয়ে আসে। এ সংশোধনী অনুযায়ী সংসদ সংবিধানের Fundamental rights সহ Basic Structure পরিবর্তন করতে পারবে। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার ইচ্ছেনুযায়ী ভূমি অধিকার করতে পারবে পাশাপাশি এর মূল্য নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ৩১ অনুযায়ী এ সম্পত্তির অধিকার থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করতে পারবে। এর পরেই আসে আমাদের কেশবানন্দ ভারতী সাহেব।

কেশবানন্দ ভারতীর পরিচয়ঃ কেশবানন্দ ভারতী ছিলেন কেরালা রাজ্যের বিখ্যাত শংকরাচার্য। তিনি ১৯ বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন। যেহেতু ছিলেন তিনি এডনির আশ্রমের একজন শংকরাচার্য সেহেতু আশ্রমের সমস্ত সম্পত্তির দেখাশোনা ছিল তার দায়িত্ব। বামপন্থী সরকার গঠনঃ এ সময় কেরালা রাজ্যে বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এবং ১৯৬৯ সালে Land reforms Act(ভূমি সংস্কার আইন) জারি করা হয়। এই আইন বলে সরকার যেকোনো সম্পত্তিতে কব্জা করতে পারে। অর্থাৎ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তিও কব্জা করতে পারবে। সরকার এই আইন অনুযায়ী হাজার হাজার একর সম্পত্তি কব্জা করে ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করতে থাকলে। এডনির মঠের জমিও হারানোর সংকট দেখা দেয়। যার ফলে কেশবানন্দ ভারতী Kerala High Court এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেন। এই মামলায় কেশবানন্দ ভারতীর এডভোকেট ছিলেন নানা পালখিভালা। যাইহোক , এই মামলার রায় যায় কেশবানন্দ ভারতীর বিপক্ষে।

সুপ্রিম কোর্টে কেশবানন্দ ভারতী মামলাঃ ১৯৭০ সালের ২১ মার্চ কেশবানন্দ ভারতী সুপ্রিম অয়ায়া আর্জি দায়ের করেন যে তার আর্টিকেল ২৫ ও ২৬ অনুযায়ী ধর্মীয় স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। আর্টিকেল ২৫ এ বলা আছে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার আছে এবং ২৬ এ বলা আছে নাগরিক তার নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানপরিচালনা ও সেই সাথে ধর্মীয় সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি অত্যন্ত গুরত্বের সঙ্গে দেখে যেহেতু মামলাটির সাথে অনুচ্ছেদ ৩৬৮,১৩,২৬, ২৫,২৪ জরিত। সুতরাং ভারতীয় সংবিধানের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় মামলা। তাই সুপ্রিম কোর্ট ১৩ জন বিচারকের একটি বেঞ্চ গঠন করে। এবং ৫৮ দিন পর্যন্ত শোনানী চলে।

মামলায় মূল প্রশ্নঃ মামলাটির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, ” সংসদ কি সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ সংশোধন করার অসীম ক্ষমতা রাখে?

মামলার রায়ঃ মামলাটি ১৩ জনের জাজের মধ্যে ১ ভোটের ব্যবধানে রায় হয়। এই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, ” সংসদ সংবিধানের যেকোনো অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করতে পারবে কিন্তু কখনোই সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার পরিবর্তন করতে পারবে না। এই রায়ে ২৪ তম সংশোধনী কে ও বৈধতা দেওয়া হয়। কিন্তু বেসিক স্ট্রাকচার কি এটা সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেনি! সুপ্রিম কোর্ট বলেন,” যখন যখন প্রয়োজন পরবে তখন তখন সুপ্রিম কোর্ট বলে দিবে বেসিক স্ট্রাকচার কী?!” যাইহোক এই যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব প্রকাশ পায়।

উপসংহারঃ যদিও বেসিক স্ট্রাকচার ধারণাটি সঙ্গায়িত করা হয়নি কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরালা মামলায়! তবে আমরা বেসিক স্ট্রাকচার বলতে বুঝি সংবিধানের বিভিন্ন মূল গঠনপ্রণালী সমূহ যেমন – সেপারেশন অফ জুডিসিয়ারি, সুপ্রিমেসি অফ কনস্টিটিউশন ইত্যাদি। কেশবানন্দ ভারতী মামলা শুধু মাত্র ইন্ডিয়ান সংবিধানের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ না এটি বাংলাদেশ সংবিধানের জন্যও একটি ল্যান্ডমার্ক কেস।

লেখকঃ শরিফুল ইসলাম

আইন বিভাগ (দ্বিতীয় বর্ষ),

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

20 thoughts on “কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অফ কেরালা (Keshavanda Bharti vs. State of Kerala)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *