উত্তরাধিকার আইন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে তার উত্তরাধিকারীদের উপর বর্তানোর যাবতীয় বিধি-বিধান নিয়ে আলোচনা করে। সুতরাং এ আইনের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো একেবারেই পারিবারিক বলে পারিবারিক আইন অনুযায়ীই এগুলো পরিচালিত হয়। মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রায় সব ধর্মাবলম্বীদের, এমনকি উপজাতীয়দেরও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধি-বিধান আছে।
মুসলমানদের উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধানগুলো কোরআন ও হাদীসের আলোকে তৈরী। এ উত্তরাধিকার আইনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত হলেও মৃত ব্যক্তির মৃত ছেলের সন্তান-সন্তানাদির উত্তরাধিকার বিষয়ে আলোচনা করে, এমন একটি বিধান নিয়ে মুসলমান সমাজে প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু এ বিষয়ে সংস্কার সাধনের চেষ্টা বা উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত ষাটের দশকের গোড়ার দিকে এ সংক্রান্ত বিধানটির সংস্কার সাধন করা হয়েছে, যার বিস্তারিত আমরা জানতে পারবো পরবর্তী আলোচনাগুলোতে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উত্তরাধিকার বর্তানোর নিজস্ব নিয়ম ও মতবাদ রয়েছে। ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের ব্যাপক সংস্কার করা হলেও বাংলাদেশের হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের বিধানগুলো এখনো মান্ধাতা আমলের। সনাতন যুগের এ আইন প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশে হিন্দু মেয়েদের অধিকার থেকে বঞ্চনার ইতিহাস তৈরী করছে। এ নিয়ে থাকবে তুলনামুলক আলোচনা।
খৃষ্টান, বৌদ্ধদেরও উত্তরাধিকার আইন ও তার প্রয়োগ সম্পর্কিত বিধি-বিধানের পাশাপাশি গুরুত্বসহ বিষয়ভূক্ত হয়েছে উপজাতীয় সমাজে প্রচলিত উত্তরাধিকারের নিয়মগুলো।
আরো একটি বিষয়, বর্তমানে ধর্মীয় গন্ডি পেরিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা লক্ষনীয়। সুতরাং থাকছে ১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইনে সম্পন্ন বিবাহিত দম্পত্তিদের সন্তানদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত আইনের বিস্তারিত আলোচনা।
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন ও আইনের উত্স:
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন কি?
ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কোন মুসলমান মারা গেলে তার ফেলে যাওয়া সম্পত্তি বা ত্যাজ্য সম্পত্তি কিভাবে কাদের মধ্যে বন্টন করা হবে সে সম্পকির্ত বিধানকে মুসলিম উত্তরাধিকার বা ফারায়েজ বলে।
উত্তরাধিকার আইনের উত্স:
১. কোরআন
২. হাদিস
৩. ইজমা
৪. কিয়াস
৫. আরবীয় প্রথা
৬. বিধিবদ্ধ আইন
৭. আদালতের সিদ্ধান্ত
১. কোরআন
উত্তরাধিকার আইনের প্রথম ও প্রধান উত্স আল-কোরআন।আল কোরআনের সূরা নেসায়ের সপ্তম,অষ্টম,একাদশ,দ্বাদশ এবং একশত ছিয়াত্তর আয়াতে প্রত্যক্ষভাবে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে বলা আছে। যেমন- মুসলিম উত্তরাধিকার বা ফারায়েজ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা নিসায় বলা আছে যে, ১২ জন সম্পত্তির অংশীদার। যাদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ এবং ৮ জন নারী।পুরুষগন হলেন মুসলিম আইনে কোরআনের পবিত্র বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ বা উত্তরাধিকারীগণ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে সুনিদির্ষ্ট অংশ লাভ করিতে বাধ্য থাকে।
২.হাদিস
এক কথায় হাদিস হলো হযরতের উক্তি, নিদের্শাবলী এবং তার জীবনের কার্যাবলীর মহাসংকলন।মুসলিম আইন বিজ্ঞানের বিধান মোতাবেক যে সকল বিষয় সমূহ হাদিসের ক্ষেত্রে অপরিহার্য তা নিম্নরূপ-ক. হযরত মুহম্মদ(সঃ) এর অভিমত,উক্তি,শিক্ষা,উপদেশ,অনুশাসন এবং বাণীর সংকলন বিষয়ক মন্তব্যখ. হযরতের দৈনন্দিন জীবন যাপন প্রণালী,কমর্তত্পরতা এবং হযরত কতৃর্ক সম্পাদিত কার্যাবলী বিষয়ক তত্পরতা,গ. হযরতের পছন্দনীয় কার্যাবলী এবং অপছন্দনীয় কার্যসমূহের বিবরণ মূলক বক্তব্য,ঘ. হযরত কতৃর্ক তার সাহাবীদের ক্ষেত্রে ইঙ্গিতবাহী সম্মতি বা নীরব সমথর্ন।যেমন- হযরত ফাতেমা(রাঃ) একবার দাবী করেন যে, তিনি তাঁর পিতার সম্পদের ওয়ারিছ। কিন্তু এর উত্তরে হযরত আবুবকর(রাঃ) রাসুলুল্লাহর পবিত্র বাণী” আমরা,নবীরা কোন সম্পদ ওয়ারিছদের জন্য রেখে যাই না; আমাদের যা থাকে, তা অবশ্যই খয়রাতের জন্য’। এই হাদিসের সত্যতা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করল না। হযরত ফাতেমার(রাঃ) দাবি অগ্রাহ্য করা হল।
৩. ইজমা
প্রকৃত অর্থে উলেমাগণের ঐক্যমত্যই হইল ইজমা এবং উহা অভ্রান্ত বলিয়া ধরিয়া নেওয়া হয়। কোরআন, হাদিস এবং সুন্নাহর মাধ্যমে যে আইন প্রনয়ণ কাজ চলে আসছিল তা হযরতের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে যায় অথচ নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হতে লাগল যার সমাধানের জন্য কোরআন, সুন্নাহ কিংবা হাদিসের মধ্যে কোন নিদের্শ পাওয়া যেত না। এমতাবস্থায় অন্য কোন উপায়ে ঐ সব সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন হয়ে পড়ত। এই উদ্দেশ্যে অাইনবিদগন আইনের যে নীতির উদ্ভব করেছিলেন উহাই ইজমা।যেমন- ধমীর্য় অনুশাসনের ব্যাপারে যেমন- রোজা, নামাজ,জনগণের সম্মিলিত মত দ্বারা বিধি প্রণয়ন, হযরত আবুবক্করকে খলিফা নিযুক্ত করা ইত্যাদি ঐক্যমত বা ইজমার দ্বারা হয়েছিল।
৪.কিয়াস
যখন কোন সমস্যা সমাধানের জন্য কোরআন,সুন্নাহ বা ইজমার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না যায় তখন কিয়াস অথার্ত্ “ফলপ্রসু যুক্তি”-র দ্বারা সমাধান করাকে কিয়াস বলা হয়।যেমন- ইসলামে মাদকতা সৃষ্টিকারী তীব্র পানীয়কে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মদকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ না করা হলেও যেহেতু মদ মাদকতা সৃষ্টিকারী তীব্র পানীয়, সুতরাং সাদৃশ্যমূলকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে বিবেচিত হয়। এটাই কিয়াস।
৫.আরবীয় প্রথা
মুসলিম আইনের পঞ্চম উত্স হল প্রাক ইসলামী প্রথা। কোরআন, হাদিস, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস ব্যতীত আইনবিদগণ যে উত্সটির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন সেটা হল রীতি বা প্রথা। বহু পুরাতন আরব প্রথা কোরআনের আয়াত দ্বারা নাকচ করা হয়েছে। যা কোরআন কতৃর্ক নাকচ করা হয় নি এবং যা সুন্নাহ কতৃর্ক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গৃহীত হয়েছে, উহা মুসলিম আইনের বিধি হিসাবে বতর্মান রয়েছে।যেমন- প্রাক ইসলামী প্রথায় যিহার, ইলা, খুলা ইত্যাদি যে কোন প্রকার প্রথার মাধ্যমেই তালাক বা বিবাহ- বিচ্ছেদ হত, তালাকপ্রাপ্তাকে পুনরায় বিবাহ করার আগে কিছু কাল অপেক্ষা করতে হতো। এরূপে কোন নারীর পুনবির্বাহের পূর্বে এই অপেক্ষমান সময়কে ইদ্দত পালন বলে। ইসলামী আইনেও নিদির্ষ্ট মেয়াদে ইদ্দত পালন করতে হয়।
৬. বিধিবদ্ধ আইন
বাংলাদেশে মুসলমানদের উপর শুধু মুসলিম ব্যক্তিগত আইনই প্রয়োগ করা হয়। উত্তরাধিকার,বিবাহ,বিবাহ-বিচ্ছেদ, উইল, হিবা এবং ওয়াকফ্ সংক্রান্ত বিষয়গুলিতে মুসলিম আইন প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়াও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন সম্পর্কে ও কতিপয় আইন বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ঐ প্রকারের আইনগুলোকে ৬ষ্ঠ উত্স বলে মুসলিম আইন বিকাশে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।বিধিবদ্ধ আইন হিসাবে আইন সভা দ্বারা পাশকৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো হল:১.শরীয়া আইন,১৯৩৭২.মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৭৩.মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ,১৯৬১( অধ্যাদেশ নং ৮)৪.মুসলিম বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ রেজিষ্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪
৭. আদালতের সিদ্ধান্ত
দেশের উচ্চ আদালতের কোন জটিল বিষয়ের সিদ্ধান্তও মুসলিম আইনের উত্স হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
মো: মনিরুজ্জামান মনির,
আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।